Breaking News
Loading...
Sunday, April 10, 2011

মাদ্রাসায় মোবাইল ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক

12:10 PM
প্রযুক্তি আল্লাহতায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। যা পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ চাঁদ জয় করেছে, মঙ্গল ছুঁয়েছে। পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনেছে ঘরে বসে। যা কিছু মানুষ আগে ভাবতেও সাহস পেত না, তা আবিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছে প্রভু মানুষকে কত জ্ঞানশক্তি দিয়েছেন। প্রযুক্তিকে নেয়ামত ভাবেন এমন লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে বেদাত, হারাম উক্তিকারীদের দল ছোট হলেও তারা শক্তিশালী। এখনও অনেক মসজিদে মাইক নিষিদ্ধ। আজান, নামাজ হয় কণ্ঠসুরে।


প্রযুক্তি নেয়ামতের প্রচণ্ড শক্তিশালী এক অধ্যায়ের নাম মোবাইল। এক সময় মানুষ মোবাইল ব্যবহার করত বিশেষ শখে কিংবা বিলাসের জন্য। তারপর প্রয়োজনে। আর এখন জীবনের জন্য অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মোবাইল। পূর্ণ একজন মানুষের জন্য দুটি হাত, দুটি পা, দুটি চোখ যেমন দরকার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন সঙ্গে একটি মোবাইলের। তাই যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার আদীব হুজুর মাওলানা শফিকুল ইসলাম একদিন বলেন, ‘এখন যদি মোবাইলগুলো সব বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে মানুষ ছটফট করে মরে যাবে।’

আবশ্যকীয় এই জীবনোপকরণটি নিয়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে বেশ জটিলতা দেখা দিয়েছে ইদানীং। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাগুলো নিয়ে বলছি। যেখানে ছাত্রদের জন্য মোবাইল ব্যবহার করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ, নাজায়েজ। মোবাইলবিরোধী শক্ত আইন জারি করা হয়েছে সব মাদ্রাসায়। ধরা পড়লে কর্তৃপক্ষ তা বাজেয়াপ্ত করে। ধমক, চোখ রাঙানি, চড়-থাপ্পড় থেকে নিয়ে শক্ত পিটুনি, বোর্ডিং থেকে খাবার বন্ধ, ক্লাসে বসার অনুমতি না দেয়া এমনকি বহিষ্কারের মতো দুঃখজনক ঘটনাও শোনা যায় নিয়মিত। এসব মাদ্রাসায় যেমন পত্রিকা পড়া নিষেধ, বাংলা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া বারণ, ইংরেজি মানা, স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস নিয়েও ভিন্ন ভাবনায় যাওয়া যায় না, এমনই একটি নিষেধাজ্ঞা আছে মোবাইল ব্যবহার করা নিয়ে। অবাক করার কথা হল, এত উত্তাপময় নিষেধাজ্ঞার পরও একটি মাদ্রাসার একটি ক্লাসও পাওয়া যাবে না, যেখানে মোবাইল নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে কম-বেশি প্রতিটি ক্লাসের ছেলেরাই আধুনিক এই আবিষ্কারটি ব্যবহার করছে। নানা মডেলের মোবাইল এখন তাদের হাতে হাতে। যা মানা বা মানানো সম্ভব না, এমন একটি আইন চালু হওয়ায় ছাত্ররা ঝুঁকি নিয়ে আইন ভাঙছে নিয়মিত। স্বভাবতই একজন শিক্ষার্থী যখন একটি আইন ভাঙতে বাধ্য হয় কিংবা সাহস পায়, তখন আরও দুটি আইন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে তার বুক কাঁপে না। সাহস বেড়ে যায় অনেক বেশি। দুষ্ট ও বেআদব হয়, সম্মান ও আস্থা হারায় মাদ্রাসার আইনের প্রতি। এই একটি কারণেই শিক্ষার্থীদের সারাক্ষণ দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফেরে। আতংকে ভোগে তারা, না জানি কখন ধরা পড়ে যাই। আবার শিক্ষক জিজ্ঞেস করলে শাস্তি কিংবা মোবাইল খোয়া যাওয়ার ভয়ে মিথ্যে পর্যন্ত বলে ফেলে কেউ কেউ। মোবাইলকে জোর দিয়ে ‘না’ বলে দিলেও বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিকল্প কিছুর কথা সঙ্গে বলে দেয়া হয় না। এমনও অভিযোগ আছে, মাদ্রাসা দফতরে ফোন দিলে ডেকে দেয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য বলে দেয়া হয় অমুক তো মাদ্রাসায় নেই বা খেলতে গেছে। এদিকে বাড়ির সবাই আঁৎকে ওঠে, পেরেশান হয়। এসব কারণেই কি তাহলে ছাত্ররা আইন ভেঙে হাতে মোবাইল তুলে নিচ্ছে? প্রয়োজনে মিথ্যার আশ্রয়ও নিচ্ছে। যদিও তারা কোরআন-হাদিসের শিক্ষার্থী?
অবশ্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মোবাইলবিরোধী একচেটিয়া আইন করার পেছনে কিছু কারণ পাওয়া যায়। সময়ের বন্ধু একটি মোবাইলে ইন্টারনেটে কি নেই, যা একজন তরুণকে বিপথগামী করতে পারে? মাদ্রাসার ছাত্ররা সাধারণত মা-বাবা বা পরিবারের সঙ্গে থাকে না। থাকে নিজেদের মতো কিছু পারিবারিক বাঁধনমুক্ত অবিবাহিত তরুণের সঙ্গে হোস্টেলে। এমন ছেলেদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়ার কথা বললে ভুল হবে। ঘটনা আছে, এক ছেলে হাদিসের ক্লাসে হঠাৎ ‘আউট’ বলে চিৎকার করে ওঠে। সহপাঠী, শিক্ষক সবাই অবাক- কি হয়েছে। কি হয়েছে! পরে মাথায় আবৃত রুমাল খুলে দেখা যায় কানে তার মাইক্রোফোন। রেডিওতে চলছে মাদকময় ক্রিকেট। কিছু ছেলে আছে যারা সারাদিন ক্লাসে ঝিমায়, ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। অথচ রাত পাড়ি দিচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে খোশগল্প করে, তারা সুযোগ পেলে মোবাইলে অশ্লীল চিত্র দেখে কাতুকুতু অনুভব করে। এমন মানুষও আছে, যাদের বোর্ডিংয়ে বাকি পড়ে রয়েছে, মাদ্রাসার বেতন বা ক্লাসের চাঁদা দেয়নি অথচ তার মোবাইলে ঠিকই কার্ড ঢোকানো হচ্ছে। ছাত্রদের এমন কিছু অমার্জনীয় কর্মকাণ্ডের কারণেই কতৃêপক্ষ এমন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে মনে হয় ছাত্রদের এ ব্যাপারে লাগামহীন ছেড়ে দেয়া যেমন ঠিক না, তেমনি মোবাইলবিরোধী একপেশে আইন চাপিয়ে দেয়াও বোকার স্বর্গে বাস করার নামান্তর। কেননা প্রমাণিত সত্য হল, এখন আর মোবাইলকে নানা রকম আইন-কানুন করেও ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। দেশের বড় বড় দলও তো মাঝে-মধ্যে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আবার জনগণের পরামর্শে, চাপে কষ্ট হলেও ঠিক পথে আসে। কওমি মাদ্রাসাগুলো কি পারবে আইনটি সংশোধন করতে?

মোবাইল ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া এবং সংকট সমাধানে তাদের পরামর্শ জানতে যোগাযোগ করি দেশের সেরা কওমি মাদ্রাসাগুলোয়। প্রশ্নের জবাবে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা। ঢাকার মাদানীনগর মাদ্রাসার ছাত্র মাহমুদ বললেন, ‘কেবল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কথা উঠবে কেন? পুরো শিক্ষাঙ্গন নিয়ে আলোচনা হতে পারে- স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা। সত্যি কথা হল, কোথাও মোবাইলের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না।’
যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার জালালাইন জামাতের ছাত্র তানবিরের (ছদ্মনাম) প্রতিক্রিয়া বেশ ক্ষুব্ধ। বলল, ‘নিষেধ করুক বা না করুক মোবাইল ব্যবহার করব। নিলেগা আরেকটা আনব।’ বেশ সুন্দর উত্তর দিয়েছেন চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসার হুমায়ুন আইয়ুব। ‘ছাত্র-শিক্ষক উভয় পক্ষেরই নমনীয় ভাব বজায় রাখা জরুরি। যেহেতু সবারই প্রয়োজন, তাই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে সময় পেরিয়ে গেলে সব মোবাইল জমা নিতে পারে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সারাক্ষণ ছাত্রদের হাতে মোবাইল থাকার পক্ষে আমি মত দেব না। আর তাদের ব্যবহৃত সেটগুলো অবশ্যই কম দামি, ভিডিও ক্যামেরামুক্ত হতে হবে।’ পাহাড়ি এলাকা চট্টলার ছাত্র যুবায়ের আহমদ, মুজহিরুল উলুমে অধ্যয়নরত ঢাকার এই তরুণ বলল, ‘মোবাইল আসলে অবৈধ নয়। বরং আইন হয়েছে বেপরোয়া ভাবটা কাটানোর জন্য। কেননা, হুজুরদের ছেলেদের হাতে মোবাইল আছে। সেই মোবাইলে কল দিয়ে ছেলেকে ডাকছেন বাবা।’ ক্লাসভিত্তিক মোবাইলের ব্যবস্থা থাকলে সুন্দর হয় বলে পরামর্শ দিয়েছেন জামিয়া আরাবিয়া সাভারের ছাত্রী আলিমা আক্তার। ঢাকার হাফেজ আতিক বলেন, এটা একটা কাদাময় বিষয়। হাত দিলেই কাদা লাগবে। ছাত্রের গায়ে, শিক্ষকের গায়েও। তাই আমি চুপ, কথা বলব না। জামিয়া উসমানিয়া চাটখিল, নোয়াখালীর ছাত্র হাফেজ মুমিনুল্লাহ বললেন, ‘মোবাইল ছাত্রদের জন্য ক্ষতিকর। তবু প্রচণ্ড প্রয়োজনে লুকোচুরি করে ব্যবহার করছি।’

এ ব্যাপারে শিক্ষকের বক্তব্য কী, জানতে হাজির হই ঢাকার মালিবাগের প্রধান শিক্ষক মাওলানা নাসীম আরাফাতের বাসায়। জাঁদরেল এই আলেমের মত হল, ছাত্রজীবনে মোবাইল ব্যবহার করা একদম হারাম। জীবনকে নষ্ট করে দেবে ওটা। আমি তো ছাত্র, ব্যবসায়ী না যে আমার সঙ্গে হাজার মানুষ যোগাযোগ করবে। একান্ত প্রয়োজনে তারাই সময় ঠিক করে নেবে। আমার মনে হয়, যে নিজের জন্য প্রয়োজন মনে করে, তার জন্যই প্রয়োজন। যে প্রয়োজন মনে করে না তার জন্য প্রয়োজন নেই। এটা একটা আপেক্ষিক বিষয়। আমার মোবাইল নেই, আমি কিন্তু কোন অসুবিধা ভোগ করছি না। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করারও তো প্রয়োজন নেই। সবাই বলে এতে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে। মোবাইলও তো একই সমস্যা বহন করে। তাহলে মোবাইল নিষিদ্ধ হতে বাধা কোথায়। সীমা অতিক্রম করলে আমরা ছাত্রদের ধরি। নতুন আইন হয়। সব আইন তো আর একশ’ভাগ আদায় করা যায় না। যতটুকু সম্ভব ওস্তাদরা সজাগ থাকেন। প্রায় সব ছেলেই এই আইন মেনে চলছে। কিছু তো উচ্ছৃংখল, দুষ্ট থাকবেই, সব জায়গাতেই থাকে। আমাদের আকাবেররা কোন চিঠিও পড়তেন না। তাই বলে কি তারা সময় সচেতন ছিলেন না? কথা হয় দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রবীণ ও প্রথম সারির শিক্ষক মাওলানা শোয়াইব আহমদের সঙ্গে। ‘মোবাইলবিরোধী আইন আছে। তাই চোখে পড়লে বা জানতে পারলে তা আটক করি। গোপনে ব্যবহারের শিথিলতাটুকু অবশ্য কেউ কেউ নিচ্ছে।’ এমন উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। তার এই জবাবে কথা থেকে যায়, তাই জানতে চেয়েছিলাম হুজুরদের বিশেষ খাদেম এবং ছেলেরা এমনকি আপনার সন্তানও তো মাদ্রাসায় মোবাইল ব্যবহার করছে এটা দেখেও কেন দেখছেন না? অথচ অতিসম্প্রতি আটক করা সাধারণ
ছাত্রদের অসংখ্য মোবাইল আপনাদের হাতে বাজেয়াপ্ত, তাদেরগুলো ফেরত দেন না কেন?
এমন প্রশ্নের জবাবকে তিনি চতুরতার সঙ্গে পাশ কাটিয়ে যান। কথার মাঝে ভিন্ন সুর তোলেন। অন্যের প্রতি কঠিন হৃদয়ের হলেও নিজের সন্তান, খাদেমদের ওপর আইনের শাসন নিশ্চিত করতে অক্ষম এমন একচোখা লোকই মাদ্রাসার বদনাম করেন। হাটহাজারীসহ দেশের সব মাদ্রাসা থেকে এসব দ্বৈত নীতির অবসান ঘটুক। মাদ্রাসাগুলোতে চালু হোক ভারসাম্যপূর্ণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আইন। মাদ্রাসাগুলো সৃষ্টি করুক নূরানী অন্তরওয়ালা প্রসারিত দৃষ্টির প্রজন্ম, যারা নেতৃত্ব দিতে পারবে দেশের এবং বিশ্বের। তারাই হতে পারবে ইমাম মাহদীর রুহানী সৈনিক।

**************************
তা জু ল ফা ত্তা হ
যুগান্তর, ০১ আগষ্ট ২০০৮

0 comments:

Post a Comment

 
Toggle Footer