Breaking News
Loading...
Saturday, April 9, 2011

অনন্য উপলব্ধি ...............

3:53 PM
পুর্বাকাশে নরম সুর্যের মতো তাঁর অবস্হান। সবার মাঝে তিনি বসে আছেন। সাহাবিরা তাঁর আশপাশে, মুখোমুখি। আলোর চারপাশে আলোপিয়াসীদের তৃষ্ণার্ত উপবেশন। ভোরের স্নিগ্ধ সৌরভের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ পবিত্রতা মজমাকে ঘিরে রেখেছে। তিনি সবার দিকে চোখ ফেলছেন, কথা বলছেন, শুনছেন কারো কারো কথা! তাঁর খুব কাছাকাছি বসে আছেন এক সাহাবি; যার গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণ। অদুরে অন্য অনেকের মাঝে আছেন আবু জর (রা.)।


অকস্মাৎ আবু জর, কালো বর্ণের সেই সাহাবিকে বললেন, ‘হে কৃষ্ণাঙ্গের সন্তান!’ আবু জর (রা.) কথাটি বললেন স্বভাব ও সমাজের স্বাভাবিক বোধ থেকে। আবু জর (রা.) কথাটি উচ্চারণ করলেন সমকালীন বাস্তবতার নির্দোষ উপলব্ধি থেকে। মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া তার এই অভিব্যক্তিতে কোনো খুঁত থাকতে পারে, কথাটিতে কোনো অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্য থাকতে পারে, ভাবেননি আবু জর (রা.)। কারণ, এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। যাদের গায়ের রং কালো, ঘোর কালো, তাদের লোকে সামান্য খোঁচা দিয়েই ‘কালোর কালোত্ব’ মনে করে দেয়। কালোরা সেটাই হজম করে নেয়। আবু জর (রা.) তাই করেছেন, এর চেয়ে বেশি তো কিছু নয়।

কিন্তু ভোরের শান্ত আকাশ হঠাৎ করেই মেঘে মেঘে ছেয়ে যাওয়ার মতোই রাসুলুল্লাহর (সা.) উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। অসহ্য কষ্টের ছাপ, অসঙ্গত ও অনুচিত কিছু একটা ঘটে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া সেই চেহারার মোবারক আদল দখল করে নিল। তিনি নারাজ হলেন। প্রচলিত সভ্যতা আর জাহিলি সংস্কৃতির ধরাছোঁয়ার বহু ঊর্ধ্বে মানবিকতার এক অমলিন ফরাশে যার অবস্হান, সেই রাসুলে আকরাম (সা.) আবু জরের এ একটি উক্তিতে বেদনাহত হলেন। নীরব অসন্তুষ্টির ক্ষুদ্র সরোবরে ডুব দিয়েও থাকলেন না তিনি। লক্ষ্যভেদী আশ্চর্য মায়াবী দুটি চোখ তিনি আবু জরের দিকে মেলে ধরলেন। এরপর শান্ত সমুদ্রের মতো গম্ভীর স্বরে তিনি কথা বললেন, ‘পাত্র ভরে দাও! সবাইকে সমান দাও! কাউকে খাটো করো না।’ তার কথা স্পষ্ট নির্দেশ হয়ে, অলংঘনীয় ফরমান হয়ে শুন্যে আন্দোলিত হলো।

তিনি আরো বললেন, ‘কোনো কৃষ্ণাঙ্গের সন্তানের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো সন্তানের কোনোই শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’

ছোট্ট একটি ফরমান। অনভ্যস্ত পরিবেশে এ ফরমান এক কঠোর চাবুকের মতো দুলে উঠল। সেই কথার চাবুক দুলতে দুলতে গিয়ে লাগল আবু জরের গায়, মাথায়, বিবেক ও বোধে। আবু জরের চিন্তা-চেতনার রুদ্ধ দুয়ারগুলো মুহুর্তেই খুলে গেল। রাশি রাশি আলোর বিন্দু এসে ঢুকল মগজের দীর্ঘ অন্ধকারে। আলোয় আলোয় দিশেহারা হয়ে গেলেন আবু জর; সত্যকণ্ঠ আবু জর (রা.)।

রাসুলুল্লাহর (সা.) মুখনিঃসৃত বাক্যটি শুন্যে এসে আন্দোলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবু জর (রা.) কেঁপে উঠলেন লজ্জায়, ভয়ে। কেঁপে উঠল তার অন্তরাত্মা। এরপর ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি; যখন তার আত্মা ঊর্ধ্বলোকের এক অপার্থিব, অসামান্য নুরের সন্ধান পেল, তার শরীর তখন ধুলোয় এসে নিল আশ্রয়। তারপর সমানে মাটিতে গড়াতে লাগলেন তিনি। লজ্জায়, অনুশোচনায়, অনুতাপে আর কষ্টে তার হৃদয় হাহাকার করে উঠল। তার কান্নাভেজা কণ্ঠ থেকে অনুনয় ঝরে পড়ল। কালো বর্ণের সেই সাহাবিকেই বিনয়ের সুরে, আব্দারের সুরে তিনি এবার বললেন, ‘ভাই! তুমি দাঁড়িয়ে যাও এবং দাঁড়িয়ে আমার মুখে পদাঘাত করো। এ কী বের হলো আমার মুখ থেকে।’

সত্যপন্হী, সত্যকণ্ঠ আবু জর (রা.) বিনয়, বিগলন, অন্তঃক্রন্দনে বিলীন হয়ে যেতে লাগলেন। বর্ণ-বিভাজনের যে প্রাচীর দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ধোঁয়াচ্ছন্ন মগজে, পরিচ্ছন্ন বিবেকের আঘাতে আঘাতে তাকে গুঁড়িয়ে দিলেন, মিশিয়ে দিলেন মাটির সঙ্গে।


**************************
শরীফ মুহাম্মদ
আমার দেশ, ১২ এপ্রিল ২০০৮

0 comments:

Post a Comment

 
Toggle Footer